জীবনের প্রতিটি সম্পর্কই শুরু হয় আশা নিয়ে, কিন্তু সব সময় শেষটা হয় না ঠিক সেই আশায়। যখন মা-বাবার মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব হয়, তখন তালাক হয়ে ওঠে একমাত্র সমাধান। কিন্তু বাচ্চা সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম তখন অনেক বেশি জটিল ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। একদিকে যেমন দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে, অন্যদিকে সেই বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয় নিরীহ সন্তানটি।
এই লেখায় আমরা জানবো— তালাকের পর সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব কার, শিশুর হেফাজত কাকে দেওয়া হয়, আইনি দৃষ্টিভঙ্গি কী, আর বাবা-মা হিসেবে আমাদের মানবিক দায়বদ্ধতা কতটুকু থাকা উচিত। কারণ, সম্পর্কের শেষ মানেই দায়িত্বের শেষ নয়— বিশেষ করে যখন একটা ছোট মুখ নিষ্পাপ চোখে তাকিয়ে থাকে। চলুন, জেনে নেই বাচ্চা সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম ও এর বাস্তবতা।
বাচ্চা সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম
বাচ্চা সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম সাধারণ তালাক প্রক্রিয়ার চেয়ে কিছুটা আলাদা এবং আরও গভীরভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের ছেদই নয়, এখানে একটি শিশুর ভবিষ্যত, মানসিক স্বাস্থ্য এবং ভালো থাকা জড়িয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশে ইসলামিক শরিয়াহ, পারিবারিক আইন এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এমন তালাকের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করতে হয়।
সাধারণত, মুসলিম পরিবারের জন্য তালাক দিতে গেলে স্ত্রী বা স্বামীকে মৌখিক বা লিখিতভাবে ‘তালাক’ ঘোষণা করতে হয়। তবে সন্তান থাকলে, কোর্টে হেফাজতের বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। বাবা বা মা— যার কাছে সন্তানের ভবিষ্যৎ সবচেয়ে নিরাপদ, সেই অনুযায়ী কাস্টডি নির্ধারণ হয়।
এছাড়া সন্তানের ভরণপোষণ, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং আবাসনের মতো বিষয়গুলোও আলাদাভাবে নির্ধারিত হয়। বাবা যদি আয়ক্ষম হয়, তবে সাধারণত তাকে খোরপোষ দিতে হয়। তবে মা আয়ক্ষম হলে বা সন্তানের সঙ্গে থাকে, তিনিও সহায়তা করতে পারেন।
এখানে নিচে একটি টেবিল দেওয়া হলো যা এই নিয়মগুলো সহজভাবে তুলে ধরে—
বিষয় | বিস্তারিত ব্যাখ্যা |
---|---|
তালাকের আবেদন | মৌখিক/লিখিত তালাক, স্থানীয় সালিশি বোর্ড অথবা কোর্টের মাধ্যমে |
সন্তানের হেফাজতের সিদ্ধান্ত | সন্তানের সর্বোচ্চ মঙ্গলের ভিত্তিতে (বয়স, মানসিক স্বাস্থ্য, অভিভাবকের সামর্থ্য) |
ভরণপোষণের দায়িত্ব | সাধারণত বাবার, তবে ক্ষেত্র বিশেষে উভয়ের |
আদালতের হস্তক্ষেপ | প্রয়োজনে পরিবার আদালতের মাধ্যমে কাস্টডি নির্ধারণ |
মানবিক দিক বিবেচনা | শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য, পারিবারিক পরিবেশ, এবং নিরাপত্তা |
তালাকের পর সন্তানের ভরণপোষণ কে দিবে?
তালাকের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়— সন্তানের ভরণপোষণ কে দিবে? বাংলাদেশে প্রচলিত আইন এবং ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, সন্তানের মৌলিক প্রয়োজন যেমন খাবার, বাসস্থান, পোশাক, চিকিৎসা ও শিক্ষা খরচের দায়ভার সাধারণত বাবার ওপর বর্তায়। তবে যদি বাবা অক্ষম হন, প্রয়োজনে মা কিংবা উভয়ের সম্মতিতে বিকল্প ব্যবস্থা করা যায়।
কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় আইনের কাঠামোকে ছাড়িয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, মা সন্তানের সঙ্গে থাকেন এবং খরচের একটা বড় অংশ নিজেই বহন করেন। তাই এই জায়গাটিতে আইনের পাশাপাশি নৈতিকতা ও মানবিক দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আইন অনুযায়ী ভরণপোষণের দায়িত্ব সাধারণত বাবার ওপর।
সন্তান যদি মায়ের হেফাজতে থাকে, তবু বাবাকে খোরপোষ দিতে হয়।
বাবা যদি বেকার বা আর্থিকভাবে অক্ষম হন, তাহলে কোর্ট মায়ের সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে পারে।
সন্তান যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায়, তখন ভরণপোষণ বাধ্যতামূলক নয় (সাধারণত ১৮ বছর পর্যন্ত)।
ভরণপোষণ সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ নেওয়া যায়— যদি পক্ষগুলো সম্মত না হয়।
ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী, মা ভরণপোষণ দিতে বাধ্য নন, যদি না তিনি স্বেচ্ছায় দেন।
সন্তানের বিশেষ চাহিদা থাকলে (শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা), অতিরিক্ত খরচ বাবার ওপর বর্তায়।
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে সন্তান কার কাছে থাকবে?
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে সন্তান কার কাছে থাকবে? — এটা শুধু একটি আইনি প্রশ্ন নয়, বরং একটা মানবিক, মানসিক ও ভবিষ্যৎ নির্ভর প্রশ্ন। সাধারণত, শিশুর সর্বোচ্চ মঙ্গল বিবেচনায় নিয়ে কাস্টডির সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশের পারিবারিক আইন এবং ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, ছোট শিশুর হেফাজত মায়ের কাছেই থাকে। তবে তা সবসময় নির্দিষ্ট নয়— কারণ কোর্ট পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়।
যদি বাবা-মা দুজনই সন্তানের হেফাজতের দাবি করেন, তাহলে বিচারক দেখবেন—
কে বেশি নিরাপদ, স্থিতিশীল পরিবেশ দিতে পারবেন?
কে সন্তানের মানসিক বিকাশ ও ভবিষ্যতের জন্য বেশি উপযুক্ত?
সন্তান নিজে যদি বোঝার বয়সে থাকে, তাহলে তার মতামতও বিবেচনায় নেওয়া হয়।
শিশুর বয়স ৭ বছরের নিচে হলে, সাধারণত মায়ের হেফাজতে দেওয়া হয়।
বয়স ৭-এর বেশি হলে, শিশুর ইচ্ছা বিবেচনায় নেওয়া হয় (কোর্টে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়)।
যদি মায়ের বিরুদ্ধে নেশা, সহিংসতা বা অবহেলার প্রমাণ থাকে— তাহলে বাবা কাস্টডি পেতে পারেন।
কোর্টের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, তবে আপিল করা যায়।
সন্তান ছেলে হলে এবং বয়স ১০-১২ বছর ছাড়ালে কাস্টডি বাবার দিকেও যেতে পারে।
যৌথ কাস্টডি (Joint Custody) বিশেষ ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে সম্ভব।
চলুন এবার লিখে ফেলি পরবর্তী অংশ—
বাবার বিচ্ছেদ হলে সন্তান থাকবে কার কাছে?
তালাকের পর বাবা-মা আলাদা হয়ে গেলে, অনেকেই ভাবেন— বাবার বিচ্ছেদ হলে সন্তান থাকবে কার কাছে? বাস্তবে, এটি নির্ভর করে সন্তানের বয়স, বাবা-মায়ের আর্থিক-সামাজিক অবস্থা, এবং কোর্টে প্রমাণিত নিরাপত্তার প্রশ্নে। বাংলাদেশে প্রচলিত আইন ও ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, সাধারণত কম বয়সী সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকে, যদি না মা সন্তানের জন্য অনুপযুক্ত বলে প্রমাণিত হন।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। সন্তানের বয়স বাড়লে, তার মানসিক ও শিক্ষাগত উন্নয়নের জন্য যদি বাবার হেফাজত বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়, তখন কোর্ট সন্তানকে বাবার কাছে দিতে পারেন।
- বিচ্ছেদ বাবার পক্ষ থেকে হোক বা না হোক, সন্তানের হেফাজতের প্রশ্নে কোর্ট নিরপেক্ষ থাকে।
- মায়ের বিরুদ্ধে অযোগ্যতার প্রমাণ (নেশা, সহিংসতা, অবহেলা) থাকলে বাবা হেফাজত পেতে পারেন।
- ছেলে সন্তান যদি ১০-১২ বছরের বেশি হয়, বাবার কাছে দেওয়া হতে পারে, বিশেষ করে যদি তিনি শিক্ষার জন্য উপযোগী পরিবেশ দিতে পারেন।
- মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রে, ৭-৯ বছর পর্যন্ত মায়ের কাছেই থাকেন, তবে বয়স বাড়লে কোর্ট বিবেচনা করে।
- বাবা যদি একা সন্তানকে লালন-পালনের ব্যবস্থা করেন, যেমন বাড়ির পরিবেশ, সময় দেওয়া, আর্থিক প্রস্তুতি ইত্যাদি— তাহলে হেফাজতের সম্ভাবনা বাড়ে।
- যৌথ অভিভাবকত্বের (Joint Custody) ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি লাগে।
বাচ্চা সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম: কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: তালাকের পরে সন্তানের হেফাজতের বিষয়ে কোর্ট কাকে প্রাধান্য দেয়?
উত্তর: কোর্ট সর্বদা সন্তানের সর্বোচ্চ মঙ্গল বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণত ছোট বয়সে সন্তানের হেফাজত মাকে দেওয়া হয়, যদি না তার বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর অভিযোগ থাকে।
প্রশ্ন ২: তালাকের পর বাবা কি সন্তানের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন?
উত্তর: হ্যাঁ, বাবা সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ ও দেখা করার আইনগত অধিকার রাখেন, যদি কোর্ট সে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা না দেয়। দেখা করার সময় ও নিয়ম আদালত নির্ধারণ করতে পারে।
প্রশ্ন ৩: সন্তানের খরচ যদি বাবা না দেন, তাহলে মা কী করতে পারেন?
উত্তর: মা আদালতের মাধ্যমে ভরণপোষণের মামলা করতে পারেন। কোর্ট বাবাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে বাধ্য করতে পারে সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী।
প্রশ্ন ৪: মা যদি বাচ্চা নিয়ে পুনরায় বিয়ে করেন, তাহলে হেফাজতের কি হবে?
উত্তর: এটা পরিস্থিতি নির্ভর। যদি প্রমাণিত হয় যে নতুন পরিবারে সন্তান নিরাপদ নয় বা সঠিক যত্ন পাচ্ছে না, তবে কোর্ট হেফাজত বাবার হাতে দিতে পারে।
প্রশ্ন ৫: সন্তানের বয়স কত হলে সে নিজের হেফাজতের ব্যাপারে মত দিতে পারে?
উত্তর: সাধারণত ৭ বছরের পর থেকে সন্তানের মতামত বিবেচনায় নেওয়া হয়, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোর্টই দেয় শিশুর কল্যাণের নিরিখে।
শেষকথা
বাচ্চা সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম শুনতে যতটা জটিল মনে হয়, বাস্তবে এটি তার থেকেও বেশি সংবেদনশীল। এখানে শুধু দুই ব্যক্তির সম্পর্ক ছিন্ন হয় না— বরং একটি শিশুর ভবিষ্যৎ, মানসিক স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাও জড়িয়ে থাকে। তাই তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়, বিশেষ করে যদি সন্তান থাকে, তখন কেবল আইন নয়— মানবিকতা, দায়িত্ববোধ আর ভালোবাসাও পাশে থাকা জরুরি।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, সন্তানের হেফাজত সাধারণত মাকে দেওয়া হলেও, সব কিছুই নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। বাবা-মা উভয়ের উচিত সন্তানের জন্য শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজা— কারণ, আপনারা একে অপরের সঙ্গী না থাকলেও, সন্তানের জন্য আপনাদের দায়িত্ব চিরকালীন।
শেষ কথা হলো— তালাক মানেই জীবন শেষ না, আর সন্তান থাকলেই তা আরও জটিল— এমন নয়। বরং আপনি যদি সচেতনভাবে আইন মেনে, সন্তানের ভবিষ্যৎকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সম্পর্ক ভেঙে গেলেও ভালোবাসা টিকে থাকে অন্য এক রূপে।
আর ও দেখুনঃ
- বাচ্চা সহ তালাক দেওয়ার নিয়ম
- কোর্টের মাধ্যমে তালাক দেওয়ার নিয়ম
- বউ তালাক দিলে কি সরকারি চাকরি চলে যায়?
- বিদেশ থেকে তালাক দেওয়ার নিয়ম
DISCLAIMER
এই ব্লগ পোস্ট আর্টিকেল এবং আমাদের স্যোসাল মিডিয়া একাউন্ট এর তথ্য সম্পূর্ন নিরাপদ, যাচাই করা, বিভিন্ন মাধ্যমে থেকে রিসার্স করে সবার উপকারের জন্য নেওয়া হয়েছে। আমরা বন্ধ পরিকর আপনাদের কে নির্ভুল নিতে, তারপর ও যদি আপনাদের কোন অভিযোগ ও কোন বেপার জানার থাকে আমাদের কে মেইল করুন [email protected] ধন্যবাদ।
WhatsApp চ্যানেল এ আমাদের কে ফলো করুন | Follow Us |
Telegram চ্যানেল এ আমাদের কে ফলো করুন | Follow Us |
Facebook Page এ আমাদের কে ফলো করুন | Follow Us |
Quora তে আমাদের কে ফলো করুন- | Follow Us |
Pinterest এ আমাদের কে ফলো করুন- | Follow Us |
Twitter এ আমাদের কে ফলো করুন | Follow Us |
Web Stories এ আমাদের কে ফলো করুন | Follow Us |
TikTok চ্যানেল ফলো করে রাখুন | Follow Us |