আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠকবৃন্দ, আমাদের জীবনের সঙ্গীর সঙ্গে চলার পথে অনেক সময় ছোট-বড় নানা ধরনের ঝামেলা দেখা দেয়, যা কখনো কখনো বিবাহ বিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, স্বামী বা স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রি অফিসে ডিভোর্স পেপার জমা দিতে হয়।
ডিভোর্স পেপার জমা দেওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে সঠিকভাবে একটি ডিভোর্স পেপার লেখা। কিন্তু অনেকেই ডিভোর্স পেপার লেখার নিয়ম বা তালাক দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না।
তাই আজকের আর্টিকেলে আমি আলোচনা করবো কিভাবে ডিভোর্স পেপার লেখার নিয়ম এবং এর প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত।
ডিভোর্স পেপার লেখার নিয়ম
ডিভোর্স পেপার লেখার নিয়ম নির্ভর করে আপনি কোন ধরণের ডিভোর্সের জন্য আবেদন করছেন তার ওপর। বাংলাদেশে সাধারণত দুটি ধরনের ডিভোর্স প্রক্রিয়া রয়েছে:
১) স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে:
১. নোটিশ প্রদান: – ডিভোর্সের প্রথম ধাপ হলো স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান/মেয়রের কাছে একটি তালাক নোটিশ পাঠানো। – নোটিশে তালাকের কারণ এবং বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্তের বিস্তারিত বিবরণ দিতে হবে। – নোটিশের একটি কপি আপনার স্ত্রী/স্বামীকে পাঠানো বাধ্যতামূলক।
২. সমঝোতার প্রচেষ্টা: – নোটিশ পাওয়ার পর, চেয়ারম্যান/মেয়র ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষকে ডেকে সালিশি পরিষদের মাধ্যমে সমঝোতার চেষ্টা করবেন। – যদি সালিশির মাধ্যমে কোনো আপস হয়, তাহলে ডিভোর্স প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে এবং বিবাহ বহাল থাকবে।
৩. তালাক কার্যকর: – যদি ৯০ দিনের মধ্যে কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে তালাক স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে। – তালাক কার্যকর হওয়ার পর, চেয়ারম্যান/মেয়র ডিভোর্সের সনদ প্রদান করবেন।
৪. ডিভোর্স সনদ: – ডিভোর্স কার্যকর হওয়ার পর, ডিভোর্স সনদ সংগ্রহ করতে হবে, যা ভবিষ্যতে আইনি প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ডিভোর্স সম্পন্ন করা যায়। তবে, প্রতিটি ধাপে আইনি পরামর্শ নেওয়া ভালো, যাতে প্রক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় এবং ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়।
২) ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে:
আবেদনপত্র:
আবেদনপত্রে আপনার নাম, ঠিকানা, বিবাহের তারিখ, স্ত্রীর/স্বামীর নাম ও ঠিকানা, ডিভোর্সের কারণ, সন্তানদের তথ্য (যদি থাকে), এবং আপনার দাবি (যেমন: ভরণপোষণ, সন্তানের হেফাজত) উল্লেখ করতে হবে।
আবেদনপত্রের সাথে বিবাহের সনদপত্র, স্ত্রীর/স্বামীর পরিচয়পত্র, সন্তানদের জন্ম সনদপত্র (যদি থাকে), এবং ডিভোর্সের কারণ প্রমাণের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করতে হবে।
নোটিশ:
ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, অথবা সিটি কর্পোরেশন থেকে আপনার স্ত্রী/স্বামীকে নোটিশ পাঠানো হবে।
নোটিশে ডিভোর্সের কারণ, আপনার দাবি, এবং ইউনিয়ন পরিষদ/পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশনে উপস্থিত হওয়ার তারিখ ও সময় উল্লেখ থাকবে।
সালিশ:
ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, বা সিটি কর্পোরেশন ডিভোর্সের প্রক্রিয়া শুরুর আগে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য সালিশি পরিষদ গঠন করবে।
সালিশের মাধ্যমে যদি উভয় পক্ষের মধ্যে আপস হয়, তবে ডিভোর্সের প্রক্রিয়া বন্ধ হবে এবং বিবাহ বহাল থাকবে।
যদি কোনো আপস না হয়, তবে সালিশি প্রক্রিয়ার শেষে ডিভোর্স কার্যকর হবে।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ডিভোর্স সম্পন্ন করা যায়।
আরও পড়ুনঃ মামলা থাকলে ও এখন বিদেশ যেতে পারবেন, নতুন নিয়ম জানুন
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র:
- বিবাহের সনদপত্র: বিবাহের প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজন।
- জাতীয় পরিচয়পত্র: স্বামী ও স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র।
- ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি: স্বামী ও স্ত্রীর ছবি।
- আবেদনপত্র: ডিভোর্সের কারণসহ লিখিত আবেদন।
- নোটিশ: ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়ে নোটিশ।
- সাক্ষীর নাম ও ঠিকানা: সাক্ষীদের তথ্য।
আবেদনপত্র:
- কারণ উল্লেখ: ডিভোর্সের কারণ স্পষ্টভাবে লিখতে হবে।
- স্বাক্ষর ও শপথ: আবেদনপত্রের সত্যতা নিশ্চিত করে স্বাক্ষর করতে হবে।
- সংযুক্তি: আবেদনপত্রের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করতে হবে।
নোটিশ:
- ডিভোর্সের উল্লেখ: নোটিশে ডিভোর্সের বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে।
- আপত্তি: নোটিশে জানাতে হবে যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আপত্তি থাকলে আদালতে জানাতে হবে।
- কপি পাঠানো: সঙ্গীর কাছে নোটিশের একটি কপি পাঠানো বাধ্যতামূলক।
আইনি প্রক্রিয়া:
- আবেদনপত্র ও নোটিশ জমা: আদালতে আবেদনপত্র ও নোটিশ জমা দিতে হবে।
- শুনানি: আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি শুনে সিদ্ধান্ত নেবে।
ধরন:
- তালাক: মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য ডিভোর্সের প্রক্রিয়া।
- তালাকনামা: মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য লিখিত ডিভোর্স।
- বিবাহ বিচ্ছেদ: হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য ডিভোর্স।
- ডিভোর্স ডিক্রি: আদালতের মাধ্যমে ডিভোর্স।
আইন:
- মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৪
- বাংলাদেশ পারিবারিক আইন, ১৯৬১
ডিভোর্সের বিকল্প:
- পরামর্শ: বিবাহের সমস্যা সমাধানে বিবাহ পরামর্শদাতার সাহায্য।
- মাঝারি: নিরপেক্ষ ব্যক্তির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান।
হিন্দু ডিভোর্স পেপার লেখার নিয়ম
হিন্দু ডিভোর্স আইন বলে সরাসরি কিছু নেই, কারণ হিন্দু আইনে ডিভোর্সের অনুমতি নেই। তবে, পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে আলাদা হওয়ার প্রক্রিয়া (সেপারেশন) সম্ভব। আজ আমরা এই সেপারেশন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রাচীনকালে, হিন্দু বিবাহ শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনুযায়ী সম্পন্ন করা হতো। মন্দিরে পুরোহিতের মাধ্যমে মন্ত্র পড়ে এবং আগুনকে সাক্ষী রেখে, সাত পাক ঘুরে বিবাহ সম্পন্ন হতো, যা আমৃত্যু বন্ধনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ছিল। তৎকালে বিবাহের কোনও লিখিত প্রমাণ থাকতো না।
তবে বর্তমানে, ২০১২ সালের হিন্দু বিবাহ আইনের অধীনে বিবাহ নিবন্ধন করা যায়। হিন্দু বিবাহের প্রমাণ হিসেবে একটি বিবাহ সনদ (ম্যারেজ সার্টিফিকেট) প্রদান করা হয়, যা বিচ্ছেদের জন্য প্রয়োজন হতে পারে। যদিও, সত্য এটাই যে হিন্দু আইনে ডিভোর্সের সরাসরি কোনো বিধান নেই।
আরও আর্টিকেলঃ ইউরোপের কোন দেশে যেতে কত টাকা লাগে
হিন্দু সেপারেসন প্রক্রিয়া
যখন কোনো দম্পতি তাদের সম্পর্ক আর টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন না, তখন তারা পারিবারিক আদালতে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন। এই আবেদন পাওয়ার পর, আদালত উভয় পক্ষকে ডেকে সমঝোতার চেষ্টা করবে।
যদি সমঝোতা সম্ভব না হয়, আদালত দম্পতিকে এক বছরের জন্য আলাদা থাকার নির্দেশ দিতে পারে। এই সময় পার হওয়ার পরও যদি তারা একসাথে জীবনযাপন করতে আগ্রহী না হন, তখন আদালত চূড়ান্ত সেপারেশন বা আলাদা থাকার নির্দেশ প্রদান করবে। তবে, হিন্দু আইনে সরাসরি ডিভোর্সের কোনো সুযোগ নেই, শুধুমাত্র সেপারেশনই সম্ভব।
এই সেপারেশন সম্পূর্ণ আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। আদালত যে রায় দেয়, সেটাই চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য হয়। যদি আদালত সেপারেশন মঞ্জুর করে, তাহলে স্বামীকে স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হতে পারে, যা সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই প্রযোজ্য।
চূড়ান্ত সেপারেশন হলে, আদালতের নির্দেশ অনুসারে তারা অন্য কারও সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন।
আরও দেখুনঃ IELTS ছাড়া ইউরোপের কোন কোন দেশে যাওয়া যায়
ডিভোর্স পেপার ডাউনলোড
ডিভোর্স পেপার ডাউনলোড করার জন্য নিম্নে ক্লিক করুন।
ডাউনলোড
ডিভোর্স পেপার লেখার নিয়ম নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং উত্তর
প্রশ্ন: ডিভোর্স করতে কি কি লাগে?
উত্তর: তালাকের অনুমোদিত কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মন ও মতের অমিল, চারিত্রিক ত্রুটি, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ও আর ফিরে না আসা, এবং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা।
প্রশ্ন: ডিভোর্স কোথায় গিয়ে দিতে হয়?
উত্তর: স্বামী-স্ত্রী যখন তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন, তখন মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪ অনুসারে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে একটি নোটিশ পাঠানো বাধ্যতামূলক। স্বামী বা স্ত্রীকে নোটিশের একটি কপি পাঠানোও প্রয়োজন। চেয়ারম্যান বা মেয়র নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেবেন।
প্রশ্ন: স্ত্রী কি ডিভোর্স দিতে পারবে?
উত্তর: আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ উল্লেখ করেছেন যে, তালাক সাধারণত একজন আইনজীবীর মাধ্যমে নোটিশ পাঠিয়ে কার্যকর করা হয়। তবে, যদি বিয়ের কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার না দিয়ে থাকেন, তাহলে স্ত্রী একজন আইনজীবীর সাহায্যে পারিবারিক আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করে তালাক পেতে পারেন।
প্রশ্ন: ডিভোর্স দিতে কত সময় লাগে?
উত্তর: চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে নোটিশ পৌঁছানোর দিন থেকে ৯০ দিনের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এই সময়ের মধ্যে সালিসি পরিষদ গঠন করে সমঝোতার প্রচেষ্টা চালানো জরুরি। নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে যদি সালিসের কোনো প্রক্রিয়া শুরু না হয়, তবে তালাক স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হবে।
উপসংহার
ডিভোর্স একটি গুরুতর সিদ্ধান্ত। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সবকিছু ভালোভাবে বিবেচনা করা জরুরি। আজকের আলোচনার বিষয় ছিল ডিভোর্স পেপার লেখার নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা। আশাকরি উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আপনি উপকৃত হবেন।